আমার মনের কোণে একটুকরো কালো মেঘ ভাসছে।
দোটানায় পড়ে বারবার হোঁচট খাচ্ছি। মনে পড়ে যাচ্ছে সেই ২০০২ এর কথা।
তখন ওর সাথে আমার পরিচয় হয়। সে হাই
স্কুলের শেষের দিকে আর আমি কলেজে। আমার ও আমার বন্ধুদের সাথে ওর পরিচয় হয় পেন
ফ্রেন্ডশীপ এর মাধ্যমে। ২০০৩ সালে আমার এইচএসসি পরীক্ষার পর সে সহ আরও প্রায় ২০
জনের সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। আমি তখন একটু অগোছালো হয়ে গিয়েছিলাম। পরে যখন
চেষ্টা করলাম, দেরী হয়ে গেছে।
আমি তখন ২টি জিপি সিম ব্যবহার করতাম। ২টারই
নম্বর ওকে দিয়েছিলাম। একটা সিম পরে আম্মাকে দিয়ে দিই। আর আমি ডিজুস ব্যবহার
করতাম। ২০০৭ সালের কথা। আমি বোকার মত হঠাৎ করেই সিম পরিবর্তন করে ফেলি। আজও আপসোস
করি, সেই বোকামীর কারণে অনেক বন্ধু হারিয়েছি। একদিন আম্মার মোবাইলে ওর এসএমএস এল
আমার এক বন্ধুর জন্মদিনে, বন্ধুকে শুভেচ্ছা জানিয়ে। কিন্তু কোন নাম দেয়নি। আমার
বন্ধুকে এসএমএসটা দেখাতেই সে তাকে ধন্যবাদ জানায় ফিরতি এসএমএস দিয়ে। আমি কল করলে
সে রিসিভ করে কিন্তু পরিচয় দেয়নি। লাইন কেটে দিয়ে ফোন অফ করে দেয়।
কয়েকদিন পরে আমার বন্ধুকে অন্য নম্বর থেকে
আবারো এসএমএস করে। তখন তার পরিচয় পাই। নিয়মিত যোগাযোগ হতে লাগলো আমাদের। ফোনে আর
চিঠিতে।
আমি কথা বলার জন্য ও যে অপারেটরের সিম
ব্যবহার করে তা নিলাম। কথা আর এসএমএস হত যখন তখন, তাই বলে ম্যারাথন কথা নয়।
একসময় ওকে আমার ভালো লাগা শুরু হল। মনে মনে ঠিক করলাম, ওকে আমার মনের কথা বলব।
আমার জীবন সাথী হতে রাজী কিনা জানতে চাইব।
তখনই একদিন সে চিঠিতে জানালো তার দুটি
ছেলের কথা। আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। মনে আছে সেদিন আমার পেটে কোন খাবার পড়েনি।
বন্ধুর দোকানে গিয়ে অসহায়ের মত বসেছিলাম। বন্ধুকে কিছু বলতে পারিনি। জানি সেও
কষ্ট পেত। কিন্তু আমার সে কষ্ট পাওয়া মিথ্যে। সে যে আমাকে মিথ্যে বলেছে তা ওর
কয়েকটা কথা থেকে ধরে নিয়েছি। কিন্তু ওকে এই বিষয়ে বললে, পাশ কাটিয়ে যেত। পরে
আমাকে বলেছে সে আমাকে মিথ্যে বলেছে। কারণ, এতে করে সে অনেক ঝামেলা থেকে মুক্ত
থাকতে পারছে। বিশেষ করে ছেলেদের কাছ থেকে। সে বাড়ী থেকে অনেক দূরে লেখাপড়া করতে
এসেছে, ঝামেলায় জড়াতে চায়নি। আমাকে সত্য বলার কারণ আমি অন্যরকম।
সত্যটা জানার পর থেকে আবারো সেই পুরনো
অনুভূতি ফিরে এল। কিন্ত কি করে বলব? ওকে যেন হারাতে না হয় তাই নিজের তৈরী করা এক
ফাঁদে পড়ে নিজেই কষ্ট পেতাম। ফোনে কথা বলার সময় হঠাৎ করেই চুপ হয়ে যেতাম। ও
বুঝত আমার আমি কোন কারণে কষ্টে আছি। সে জানতে চাইত, কিন্তু আমি পাশ কাটিয়ে যেতাম।
বলতাম, কিছু না। মনে চাপা কষ্ট নিয়ে ওর সাথে কথা বলতাম, ওর সাথে মজা করতাম, ওকে
বুঝতে দিতাম না আমার কষ্টের কারণ ও। সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত প্রশান্তির ঘুম কি
আমি তা ভুলে গেছি।
আমাদের মধ্যে নিয়ম ছিল যখন একে অন্যকে মিস
করব তখন মোবাইলে মিস দেব। এসএমএস এর মাধ্যমে খুনসুটি করতাম দুজনে। ধীরে ধীরে আরও
গভীরে যেতে লাগলাম। ওর সাথে কখনো মিথ্যে বলি নি আমি। স্বীকার করতাম সব কিছু। মন
হালকা হয়ে যেত। আশ্রয় চাইতাম ওর কাছে। আমার সব চিন্তা ওকে নিয়ে। স্বপ্ন ওকে
নিয়ে। আশ্চর্যরকম ভালা লাগার ছোঁয়া ওর মাঝে।
ছোটবেলায় পড়া ওর প্রিয় এক উপন্যাসের
চরিত্রের নামে ও আমাকে ডাকত। সেই প্রথম থেকেই। তখন অবশ্য জানতাম না। পরে যখন
যোগাযোগ হল তখন এই নামে ডাকার কারণ জানতে চাইলে আমাকে আসল কথাটা সে জানায়। নামটা
আমারও পছন্দের ছিল।
যখন কোন কাজ থাকত না, কল্পনায় ওর সাথে কথা
বলা আমার প্রিয় অভ্যাস। সে জানেও এটা। ও খুব অভিমান করতে পারে। যখন তখন আমার খুঁত
পেলেই অভিমান করত। অনেক কষ্টে তা ভাঙ্গাতে হত। এভাবেই চলছিলো। মনের চাপা কষ্ট
বাড়তেই থাকল। কিন্তু প্রকাশ করতে পারতাম না, যদি সে চলে যায়? যদি সে আমার কাছ
থেকে হারিয়ে যায়? আমি থাকব কি করে ওকে ছাড়া?
কিন্তু বেশীদিন থাকতে পারলাম না। এক বছরেরও
বেশী সময় সহ্য করার পর ২০১০ এর রমজানের এক রাতে ওকে বলে দিলাম মনের কথা। জানতে
চাইলাম সে আমার জীবন সঙ্গী হতে রাজী কিনা।
সে অবাক হয়ে গেল। বিয়ে নিয়ে সে কোনদিন
কিছু ভাবে নি। জীবনে বড় কিছু করতে চায় সে। আর তাতে সংসার বড় বাধা। আমাকে বলল,
“ধরো, আমরা বিয়ে করলাম, আমাদের সংসার হল।
এরপর সন্তান হল। তাকে মানুষ করতে করতেই জীবন চলে যাবে। কিন্তু জীবনে কিছু করা হবে
না। আমি বড় কিছু করতে চাই। বিয়ে, সংসার এসব গতানুগতিক জীবন আমি চাই না। আর আমি
যেরকম মেয়ে, কি জানি আমাকে দিয়ে বোধহয় বিয়ে, সংসার হবে না। আমি তোমাকে ভালবাসি
ঠিকই, কিন্তু এর অর্থ তুমি যে এভাবে নিয়েছ জানতাম না। আমি তোমাকে ভালবাসি, সেটা
বন্ধু হিসেবে। তুমি যদি এই নিয়ে বেশী কথা বল তাহলে আমি আর তোমার সাথে কথা বলব না।
তাতে তোমার ভাল হবে। জানি তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না, কিন্তু আমার যতই কষ্ট
হোক না কেন তোমার ভালোর জন্যই আমাকে এটা করতে হবে।”
ওকে যখন বললাম বড় কিছু করার পেছনে সংসার
কখনও বাধা দিয়েছে বলে মনে হয় না। পৃথিবীর অনেকেই বড় বড় কাজ করেছেন, কিন্তু
সংসার কি তাদের ঠেকাতে পেরেছে? এর উত্তর সে কি দিয়েছিল আমার মনে নেই, কারণ, আমি
অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম।
কোথায় যেন পড়েছি এবং শুনেছিও কয়েকবার
মেয়েদের এই “ভালবাসি, কিন্তু বন্ধু হিসেবে” কথাটা একটা ছলনা। পাশ কাটানোর জন্য
বলা। ওর কথা থেকে তাই মনে হচ্ছিল, ছলনাটা আসলেই সত্য। কিন্তু পরক্ষণে আবার মনে
হচ্ছিল না তা হতে পারে না। ও খুব ষ্পষ্টবাদী। যা বলে সরাসরি বলে। আমার শিক্ষাগত
যোগ্যতা নিয়ে ওর সমস্যা নেই, পরিবারের বাধাও ওর কাছে বড় নয়, ওর সাথে কারো
সম্পর্কও নেই। তাহলে? বন্ধুত্বের মাঝে প্রেম কি হয়?
মনে হয় এরপর থেকে ওর মনের আকাশ থেকে আমার
পতন শুরু হয়। সে আর আগের মত আমাকে মিস করে মিস দেয় না, ফোন দেয় না, এসএমএস এর
উত্তর দেয় না, নিজে থেকে এসএমএস করে না, করলেও সেটা কোন উপলক্ষে। বছরের উপর হয়ে
গেল কোন চিঠি সে আমাকে দেয়নি। চিঠির কথা বললেই সে বলে তার নাকি লেখালেখি ভাল লাগে
না। এটা সেটা বলে পাশ কাটিয়ে যায়। আমি বুঝি, কিন্তু বলার কিছু নেই। আর কোন কিছু
নিয়ে জোর করা আমার স্বভাব নয়। অধিকারের কথা বাদই দিলাম।
আমার মা ওর বিষয়ে জানেন। একদিন তাঁর সাথে
কথা হয়েছিল ওর। আমার মা ভেবেছিলেন আমরা প্রেম করছি। আমার মা অসুস্থ। এখন তাঁর
ছেলের জন্য বউ চান। কয়েকমাস আগে বেশী অসুস্থ ছিলেন। আমার রুমে এসে জানতে বললেন,
- “ঐ মেয়েটা কি তোকে বিয়ে করবে?”
আমি বললাম, “না, আমাদের মধ্যে এরকম কিছু
হয়নি। আর তাছাড়া ও শিক্ষায় আমার থেকে অনেক উপরে। ও আমাকে বিয়ে করতে রাজী হবে
না।”
উনি সম্ভবত আমার মিথ্যেটা ধরতে পেরেছিলেন।
মায়ের মন সব বুঝতে পারে। এরপর উনি আমাকে কয়েকটা কথা বলেছিলেন, কোন মা আমার মনে
হয় না এভাবে তাঁর ছেলেকে বলেছেন,
- “দেখ বাবা, প্রেম ভালবাসা তো খারাপ কিছু
নয়। তুই যদি ওকে ভালবাসিস আমি বা ঘরের কেউ তাতে আপত্তি করব না। মেয়ে শিক্ষিত না
অশিক্ষিত, ফর্সা না কালো আমাদের দেখার বিষয় না। তোর পছন্দ হল বড় কথা। (এরপর
সবচেয়ে অবাক হয়েছি) তার ফ্যামিলিতে প্রস্তাব দিয়ে যদি তারা রাজী না হয়, মেয়ে
যদি রাজী থাকে আর সে চলে আসতে চায়, তাহলে কোর্ট ম্যারেজ করিয়ে দেব। তাতে বেআইনী
কিছু হবে না।”
মা যে আমাকে এই কথাটা বলেছেন আমি কিছুতেই
যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কিন্তু সত্যি তিনি বলেছেন।
আমার ভাগ্যটাই খারাপ। খুব চেষ্টা করেছি আমি
ওর সাথে দেখা করতে। কিন্তু পারিনি। মানুষ চেষ্টা করলে সব পারে কথাটা হয়তো ঠিক না।
আমি তো কোন কলুষিত মন নিয়ে ওর সাথে দেখা করতে চাইনি, তবে কেন হল না? চেষ্টা তো কম
করিনি। অভিমানের এক পর্যায়ে সে আমার শহরে এসে বেড়িয়ে গেল, তাও আমার এক
কিলোমিটারের মধ্যে! দেখা হল না আমাদের। সে অবশ্য ফোনের পর ফোন দিয়েছিল, কিন্তু
আমি রিসিভ করিনি। কিন্তু সে তো এসএমএস দিতে পারত!
মা মেয়ে দেখছেন। আর আমি পিছিয়ে নিচ্ছি।
মনের মধ্যে ক্ষীণ আশা এই হয়তো সে বলবে আমাকে তার প্রয়োজন। ফোনে কথা বলার সময়
মাঝে মাঝে যখন ও বলত, “তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। তুমি কি এর জন্য মানসিক ভাবে
প্রস্তুত?” তখনই মনে হত এই বুঝি আমার মনের কথা ও বলে বসবে। কিন্তু হায়! অকারণ
ভাবাই সার!
আমার মনের যে বদ্ধ সিন্দুকে তাকে রেখেছি,
সেই স্থান আর কাউকে দিতে পারব না। এত কিছুর পরও আমার মনের ঘর থেকে তার স্থান এক
বিন্দু পরিমাণ নড়েনি। তাকে আমি খুবই ভালবাসি।
মোবাইলে ওর জন্য একটি রিংটোন সেট করে
রেখেছি, শ্রেয়া ঘোষালের কন্ঠে গাওয়া গানের অংশ। যদিও এখন তা কমন হয়ে গেছে।
কিন্তু আমি সেটা পরিবর্তন করিনি। যখন ঐ রিংটোন আশেপাশে কারও মোবাইলে বাজে, বুকের
মধ্যে ছ্যাৎ করে উঠে, জানি না কেন। নিজের অজান্তেই হাত চলে যায় মোবাইলে। যার
মোবাইলে বাজে, তাকে অকথ্য ভাষায় বলতে ইচ্ছে করে, “হারামজাদা, তুই আর রিংটোন খুঁজে
পেলি না বুঝি?”
এখন ওর স্মৃতি আমাকে পোড়ায়। রোজার সময়
আমরা বন্ধুরা মিলে ক্যারম বা কার্ড খেলি। রাত ১টা, ১:৩০ পর্যন্ত চলে তা। হঠাৎ করেই
মনে পড়ে গত বছর বা তার আগের বছর রোযাতেও এই সময়টাতে ওর সাথে কথা হত। খেলা শেষ
হতে দেরী হলে হাল্কা অভিমান করে এসএমএস করে বলত আমার খেলা কি সারা বছরেরও শেষ হবে
না? বন্ধুদের সাথে হয়তো আড্ডায় জমে আছি, তখনই মনে পড়ে যায়, এই সময়টাতে ও
আমাকে মিস দিত, এসএমএস দিত, কিংবা ফোনে কথা হত। খারাপ লাগা একটা অনুভূতি ছড়িয়ে
পড়ে পুরো হৃদয় জুড়ে। জানিনা এই সময়টাতে এখন কি করে সে। আমার মত করে কি সেও
ভাবে, আমার মত করে কি সেও মিস করে ঐ সময়?
যখন একা থাকি, ওর স্মৃতিগুলো তখনই আমাকে
ঘিরে ধরে। খুব কথা বলতে ইচ্ছে করে তখন। কিন্তু পারি না। ও আর আগের মত নেই। আগের
সেই মানুষটাকে খুব মিস করি।
আমাদের দুজনের একটি মিল হল দুজনেই বাবাকে
খুব মিস করি। তার বাবা নাই, আর আমার বাবা কাছে থেকেও দূরে। আমি কখনও নিজে থেকে
বাবা প্রসঙ্গে ওর সাথে কোন কথা বলতাম না। মনে হত, আমি বাবাকে নিয়ে কিছু বললে তার
কষ্ট হবে। সে যখন তার বাবাকে নিয়ে কথা বলত, আমার খুব কষ্ট হত। কিন্তু সান্ত্বনা
দেবার ভাষা আমার ছিল না।
জানি না ওকে আমার এই জীবনে পাওয়া হবে
কিনা। কিন্তু ওকে পাওয়ার জন্য আমি আমি কতটা ব্যাকুল তা বুঝাতে পারব না। আমার দেখা
স্বপ্নগুলো ওকে নিয়েই দেখা। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই। মায়ের
ইচ্ছে পূরণ করতে হবে হয়তো এবার। কিন্তু মনের এই কষ্টগুলোকে কোথায় কবর দেব?
আমার বুকের মধ্যে ফুল হয়ে সে সারা জীবন
থাকবে।